বিছনাকান্দির প্রেমে হারিয়ে যাওয়ার একদিন
ঠিক বিকেল ৪টায় ক্যানটিনে ডাবল টি-ব্যাগের চা পানে নির্জীব মনকে একটু সজীব করা আমার বাধ্যতামূলক অভ্যাস। চায়ের সঙ্গী হয় জয়, তোফায়েল আর মাঝে-মাঝে সৌরভ ভাই। জয় দেখতে সুঠাম দেহী হলেও বয়সে আমার ছোট, তাকে যে কোন কথা বলতে তেমন মুখে আটকাইনা। তোফায়েল সম-বয়সই হলেও অফিশিয়ালি আপনি করে বলি, তারপরেও খাতিরের অভাব নেই, মাঝেমাঝে রেগে-মেগে তুই-তোকারি করেও কথা বলি। আর সৌরভ ভাই কে আমি মন থেকে ভয় পায় দুইটা কারণে,প্রথম কারণ: বেচারা বিবাহিত মানুষ ওনাকে দেখে আমার ভবিষ্যৎ অসহায়ত্বের কারণে ভয়টা। আর দ্বিতীয় কারণ: ওনার বিগ-সো স্টাইলের রেসলার বডি। যে কারণে ওনার আর আমার গাণিতিক সূত্র দাঁড়ায়, সৌরভ=হায়দার*হায়দার।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সৌরভ ভাই বললেন, “চলেন হায়দার ভাই, আমরা কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি”। আমার ঘুরাঘুরির পোকা মাথায় ঢুকে আছে সে অনেক আগেই পোকাগুলোর কামড়া-কামড়িতে আমি এমনিতেই অস্থির প্রায়। ঘুরাঘুরির কথা শুনে আমার অবস্থা, “একেতো নাচুনে বুড়ি তার উপর ঢোলের বারি”।
সৌরভ ভাইয়ের কথা শুনে পুরাতন পোকা গুলি আবার জেগে উঠলো আর মনটাও আকুপাকু করে উঠলো।
যেই কথা সেই কাজ, সাথে সাথে সৌরভ ভাই, জয় আর আমি মিলে একটা খসড়া তৈরি করে ফেললাম। আমরা যাচ্ছি সিলেটের বিছানাকান্দি আর রাতারগুলে।
তারপর থেকে, সারাদিন ফিসফিসানি ট্যুর বিষয়ক কথা “হায়দার ভাই, এটা কি করবেন,ওটা কি করবেন”। তারপর আবার বৈকালিক নাস্তার সময় গোপন বৈঠক, কিভাবে,কখন, কি করবো। এই ট্যুরে আরো থাকছে আমার সবসময়ের সফরসঙ্গী সহযাত্রী খুব কাছের বন্ধু গত খাগড়াছড়ি ট্যুরের ব্যর্থ ম্যানেজার টিপু, নব বিবাহিত লাজুক ছেলে কবি আব্দুল গাফ্ফার,আর নর-সুন্দর জিসান।
বরাবরের মত এবারো টিকিট সংগ্রহ করার যত ঝক্কি-ঝামেলা আমি নিজের কাঁধে নিলাম সানন্দে, টিকেট সংগ্রহেও কমকাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি, মানুষ ৭ জন,৪টি টিকিট করলাম কেবিনের, ১টি চেয়ারের বাকি দুইটি ভৈরব স্টেশন থেকে তোফায়েল শ্বশুরের বিশেষ লিংক ব্যবহার করে সংগ্রহকৃত, তাও ওই টিকেট ভৈরব থেকে পেতে হয়েছে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। আমাদের প্রতিনিধি ইন্টারনেট বলছে, ক্রয়কৃত ট্রেন টিকেট কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানোর ঘটনা ইতিহাসে বিরল।
যাওয়ার দুইদিন আগ থেকে আমার আবার পেটের মধ্যে পুটপুট-ঘুটঘুট, আমি একটু ঘরে বাইরে। একটু পরপর পেটে মোচর দিয়ে আমি ভোঁ-দৌড় সেই আসল ঠিকানায় ছোট্ট ঘরে, আমি আর আমি নেইরে পাগলা! কিন্তু অন্যদের কাছে সব চেপে গেলাম, কারণ দল নেতার যদি এই করুন অবস্থা হয় অন্যরা মানসিক ভাবে অনেক ভেঙ্গে পড়বে তার চেড়ে বড় কারণ হলো আমাকে পঁচিয়ে ওরা বুনো উল্লাস করবে এতে আমার মান-ইজ্জতের উপর দশ টনি ট্রাক উঠবে তা পূর্বের অনেক ঘটনা থেকে পরীক্ষিত।
যাই হোক এক পাতা মেট্রিল ট্যাবলেট আর স্যালাইন ব্যাগে নিয়ে, চিকেন সুপ খেয়ে মনকে চাঙা করে আল্লাহর উপর ভরসা করে ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম তোফায়েল কে নিয়ে, অন্যদিক থেকে কবি আব্দুল গাফ্ফার, জিসান আর টিপু আসবে স্টেশনে। দলনেতার অবাধ্য হওয়ার মাশুল দিতে হয়েছে জয় আর সৌরভ ভাইকে দৌড়া-দৌড়ি করে ট্রেন ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে যখন ট্রেনে উঠে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বললো হায়দার ভাই আমরা ঠিক সময়ই এসে পৌঁছেছি! আমিও বললাম, “হুম অনেক আগেই চলে এসেছেন, প্রায় পাঁচ মিনিট আগে”। রাত ৯:৫০ মিনিটের ট্রেন ওনারা এসেছেন ৯:৪৫ মিনিটে।

(বা-থেকে) জয়, দলনেতা আমি, জিসান, টিপু, তোফায়েল এবং কবি আব্দুল গাফ্ফার। সৌরভ ভাই ক্যামেরার পিছনে।
চার জনের ক্যাবিনে আমরা সাত জন, একদম প্রাইভেট ক্যাবিনবুঝা গেলো সবার জামা কাপড় খুলে হালকা হওয়া দেখে। উঠেই দলনেতা হিসেবে আমার উদ্বোধনীবক্তব্য দিতে হবে, এটার অডিও এবং ভিডিও করছেন কবি আব্দুলগাফ্ফারতার ওয়ালটন মোবাইলে,দলনেতার বক্তব্য বলে কথা! মিডিয়া কাভারেজ স্বাভাবিক!
প্রিয় সহযাত্রী বৃন্দ,
আসসালামুয়ালাইকুম, অনেক দিনের প্ল্যানকৃত ট্যুরের আজকে আমরা যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ। সবাইকে শুভেচ্ছা ও স্বাগতম দলনেতার পক্ষ থেকে। ধন্যবাদ দিচ্ছি আমি নিজেকে কারণ অনেক ঝক্কি-ঝামেলা মাথায় নিয়ে এসব শয়তান পোলাপাইনের জোর জবর-দস্তি ভাবে টিম লিডার হওয়ার দুরসাহস দেখানোর জন্য। আমি সবার প্রতি অনুরোধ করবো যাতে দলনেতা হিসেবে আমার মান ইজ্জত বজায় থাকে আর তোমাদের শয়তানী মূলক সব কর্ম-কান্ডকে আমি যাতে শক্ত হাতে কন্ট্রোল করতে পারি, সর্বোপরি সহিসালামতে ফিরে আসার সেই শুভ কামনা করে আমার বক্তব্য এইখানে শেষ করছি।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, জয় বাংলা।
সবাই অট্ট হাসিতে অপমান মূলক করতালির মাধ্যমে আমাকে অপমান করারও চেষ্টা করলো, কিন্তু মানির মান আল্লাই রক্ষা করে।
ওরা চারজন এখন তাস খেলবে আর বাজি ধরল আমাকে নিয়ে, যে দলেই জিতবেনা কেন, কিল-ঘুষি নাকি আমাকে খেতে হবে! এর আগে এসব জুয়া খেলায় বউ বিক্রি করে দিতে শুনেছি, কিন্তু ওরা সবাই মিলে কেন যে আমার উপর ক্ষেপলো?
দুই ঘণ্টা কার্ড খেলা শেষে এখন গানের কলি খেলা।
গান যে অক্ষরে শেষ হবে সে অক্ষর থেকে অন্য গ্রুপের ধরতে হবে।
প্রথমে আমার গ্রুপের বাংলা সিনেমার হিরো জিসান শুরু করল, সুর মিলালাম আমরা সবাই।
“চুমকি চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে
রাগ করো না সুন্দরী গো
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো
সুন্দরী চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে”।।
এই ‘ত’, ‘ত’। এখন ‘ত’ দিয়ে গান ধরতে হবে সৌরভ ভাইয়ের গ্রুপকে,
“তোমাকে চাই আমি আরো কাছে
তোমাকে বলার অনেক কথা আছে
আমি বলতে পারি না……….. ”
এই ‘ন’, ‘ন’। এবার আমাদের গ্রুপের পালা, আমি ধরলাম।
“নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ননাইরে টেলিগ্রাম
বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম……….. ”
এরপর অনেকক্ষণ চললো এই গান-গান খেলা
“সবাই তো ভালোবাসা চায়
কেউ পায় কেউবা হারায়
তাতে প্রেমিকের কী আসে যায়”
“এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলোতো? ”
‘ত’ এক, ‘ত’ দুই, ‘ত’ তিন, ‘ত’ চার……. ‘ত’ দশ
হুররে…….জয়, টিপু আর সৌরভ ভাই এর গ্রুপের বিজয় উল্লাস।
বাংলা ছায়াছবির গানের রাজা জিসানকে নিয়েও প্রত্যেকবারই আমার গ্রুপ হারলো।
অনেক হয়েছে আর না, চোখের পাতা আর মানতে চাচ্ছেনা। সবাই ঘুম ঘুম চোখে যে যেদিকে পারছে ঢলে পড়লো ঘুমের রাজ্যে। সকালের আলো ফুটে দেখি আমরা সিলেট স্টেশনে। নেমে নাস্তা খেয়ে আম্বরখানা যেতে হবে, ওখান থেকে অন্য সিএনজিতে যেতে হবে হাদারপার।
রাস্তায় যে নৌকা চলে এই প্রথম দেখলাম, এই রাস্তাটা মনে হয় নদীময় রাস্তা। রাস্তার এবড়ো-থেবড়ো আর ভাঙাচোরা অবস্থার করণে সিএনজি হলেও মনে হচ্ছে আমরা নৌকা করে যাচ্ছি। খারাপ কি, সিএনজির দামে নৌকা। ভালোতো, ভালোনা!!
হাদারপার থেকে দুপুরে খাওয়ারে জন্য গণি মিয়ার বিরিয়ানি নিয়ে সারাদিনের জন্য ছাদহীন নৌকা ভাড়া করলাম অনেক দর কষাকষিকরে।
নৌকায় হিমহিম শীতল বাতাসে আমাদের চুল উড়ছে, মনের মাঝে বয়ে চলছে অনেক রোমান্টিক এক ভাব, শেষ বারের মত তোফায়েল আর সৌরভ ভাই তাদের একেবারে ব্যক্তিগত বউকে আপডেট দিয়ে জানিয়ে দিলো আর কিছুক্ষণের মাঝে আমরা নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাচ্ছি। নব-বিবাহিত আব্দুল গাফ্ফার এই মেঘলা দিনেও সানগ্লাস পরে নৌকার সামনে গিয়ে টাইটানিক স্টাইলের এক পোজ দিলো। তাতে চিকনা টিপু আর ভূটকু জিসান যে অন্তর-জ্বালায় পুরবে সেটাই স্বাভাবিক, এমনিতেই জিসান আর আব্দুল গাফ্ফার দুই সতিনের মত ঝগড়া করে, টিপু আর আমি সে ঝগড়ার ইন্ধন দিয়ে আলিফ লাইলার মালিকা হামিরার মত শয়তানি অট্ট হাসিতে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলি। যাই হোক, সবাই নৌকার সামনে গিয়ে একে একে টাইটানিক স্টাইলে পোজ দিলো। যদিও, ওটা ছিলো টাইটানিক জাহাজ আর এটা হলো টাইটানিক নৌকা। তাতে কি, টাইটানিক-ত, শুধু একজন ক্যাট-উইন্সলেটের অভাব।
অনেক আগেই একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম
“আমি হারিয়ে গিয়েছি কোন রঙিন প্রজাপতির দেশে।
কুয়াশাচ্ছন্ন ঝাপসা প্রভাতে
খালি পায়ে হাঁটছি পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা রাস্তায়
মাথা দিয়ে বসে আছি হিম-হিম পাহাড়ি ঝরনায়।
আর গান ধরেছি
নিজের মন থেকে কোন বেসুরা সুর তুলে”।
মনে হচ্ছে,আমি এখন সেই স্বপ্নের প্রজাপতির দেশে আছি, একদম পৃথিবীর নেটওয়ার্কের বাইরে।
কি নেই এখানে পাহাড়ি ঝরনা, সবুজ প্রকৃতি আর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়।
পাহাড় আর নদীকে আমার খুব ভালো লাগে, খুব কাছের বন্ধু মনে হয়।
সব সময় মাথা উঁচু করে আকাশের সাথে কথা বলা ওই বড় বড় পাহাড়গুলোর কোন অহংকার নেই, বরং সবাইকে নিজের কাছে ডেকে বলে, “ও ভাই মানুষ, এসোনা আমার বাড়ি, পাহাড়ি ফলের বাগানে, পাখির গানের রাজ্যে, ঝরনার কাছে”।
আর পাহাড়ি ঝরনা থেকে ধেয়ে আসা পানির স্রোতের যে নদী তাতেও কোন তর্জন গর্জন নেই, কোন হুংকার নেই। এক অনাবিল আনন্দের সাথে বয়ে চলা নদীর সাথে নিজের মনের যত দু: খের কথা বলে হালকা হওয়া যায়। এমন পাহাড় আর নদীকে ভালো না লেগে কি পারে?
এযেন বই-এ পড়াকোন গ্রাম। নৌকার দু’পাশে
সবুজ গ্রামের প্রতিচ্ছবি। প্রকৃতির সৌন্দর্যে অপরূপ শোভিত দু’পাশের গ্রামগুলো। নদীর দু’ধার ঘেঁষে হাঁসের ঝাঁকের ঝুপঝাপ-লাফালাফি,সারিসারি গাছগাছালি,কোথাও খালি মাঠে গরুর পালের ঘাস খাওয়ার দৃশ্য, কেউ আবার গরুকে গোসল করাচ্ছেন, নদীর একুল থেকে ওকুলে ল্যাংটু ছেলেদের সাঁতরে পার হওয়া। সবই যেন গল্পে পড়া কোন কল্প-কাহিনী।
হঠাৎ চোখে পরলো কোন রাখালি পল্লী বধূর স্নিগ্ধ বাতাসে হিমহিম এই নদীর পানিতে সদ্য স্নান করে কাঁখে কলসি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সাথে টুকটুকে ছোট্ট খুকিকে নিয়ে, হঠাৎ আমাদের দেখে লজ্জায় লাল হয়ে, আঁচলে মুখ লুকিয়ে হারিয়ে গেল কোন সবুজ গাছের আড়ালে। নৌকা থেকে পাহাড়ি খেলুড়ে ছেলে-মেয়েদের হাত নাড়িয়ে টাটা দিচ্ছি, তারাও অনেকে টাটার জবাবে নেচে-নেচে আমাদের টাটার জবাব দিলো, আর একটু বয়সী স্কুল পড়ুয়া মেয়েগুলো টাটার জবাব দিলো মুখ ভ্যাংচিয়ে। এতো প্রকৃতির রং-রূপ, এতো রঙ্গলীলায় কেউ নিজেকে না হারিয়ে পারবে না।
এতক্ষণে আমরা পৌঁছে গেলাম পাংথুমাই ঝরনাতে। এত সুন্দর আর বড় ঝরনা এই প্রথম দেখলাম, কিন্তু ঝরনার কাছে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, কারণ ঝরনার অনেক আগেই সাইন বোর্ডে লেখা “সামনে ভারত, অতিক্রম নিষেধ”। তার মানে আমরা এখন ভারত-বাংলাদেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে আছি। এই ঝরনার পানিতে গোসল করার সাধ আর মিটলো না। আফসোসও হলো অনেক, পাহাড় ঝরনা সবই-তো ভারতের পাশে আমাদের জন্য আছেটা কি?
কবি আব্দুল গাফ্ফার হুংকার ছেড়ে আবারও আরেকটা যুদ্ধের ঘোষণা দিলো, এই যুদ্ধ পাহাড় ও ঝরনা অবমুক্ত করার যুদ্ধ। কবি আব্দুল গাফ্ফার ভারতের সীমানার মধ্যেই এক নাম্বার প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিয়ে একটা নীরব প্রতিবাদ করলো। তবে তাতে তাকিয়ে থাকা বিএসএফএর গুলির আশঙ্কাও কম ছিলোনা।
আবার নৌকায় উঠে লক্ষণছড়া আরেকটি ঝরনা পথে যাত্রা করলাম, এতে কিছুদূর নৌকায় গিয়ে আরো ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে দুষ্টামি আর খুনসুটিতে ভরা ছিল সবার মন, খালি পায়ে গ্রামের কর্দমাক্ত রাস্তায় হেঁটে শরীর শিহরিত হচ্ছে, ইচ্ছে করেই ভালো জায়গায় না হেঁটে কাদা দিয়ে হাঁটছে সবাই। খুব ইচ্ছে ছিলো শুধু চোখ দু’টা বাদে সারা শরীরে কাদা মেখে মহিষের লাঙল ধরে কৃষকের সাথে ছবি তুলবো। সময়ের অভাবে গায়ে কাদামাখা হয়নি তবে রাস্তায় এক কৃষকের টুকরি মাথায় দিয়ে আর কাঁধের ভার বহন করে খুব মজার ছবি তুললাম।
কবি আব্দুল গাফ্ফার বললো, এই গ্রামে রাতে থাকতে পারলে ভালো হতো।
চারিদিকের সবুজের সমারোহের এই গ্রামে রাতে থাকার দৃশ্য একবার কল্পনা করে নিলাম।
জ্যোৎস্না ও জোনাকির রাতের পরিবেশে কোন পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তাঁবু টানিয়ে কোনো শহুরে নাগরিক হেডটর্চ জ্বালিয়ে যদি কোন রোমাঞ্চকর প্রেমের গল্প পড়ত তাহলে মনে হয় জীবনটা সার্থক হতো।
এ গ্রামে রাতে না থাকার আপসোসটা ঠিক এভাবে প্রকাশ হলো মনের গহিনে।
ইস!যদি
কোন চাঁদনি রাতে দূর্বাঘাসে শুয়ে
অচিন কোন পাথরে হেলান দিয়ে
আনমনে হয়ে তারা গুনতে পারতাম।
ইস!যদি
জোনাকির মিটি-মিটি আলোয়
ঝিঁঝি পোকার ঝিঁঝি গানের সূরে
যদি গান ধরতে পারতাম।
এসব শুধু কল্পনা, এখন আবার নৌকায় ফিরতে হবে।
এবার আবার ছাদহীন নৌকায় বিছনাকান্দির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে মনে হচ্ছে এখনি বৃষ্টি নামবে। এক সময় ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে নেমে এলো প্রশান্তির ঝুম বৃষ্টি। একটু আগে খিট-খিটে রোদ ছিলো, এখন ঝুম বৃষ্টি। নদীর মাঝে ছাদহীন নৌকায় নিশ্চুপ বসে বৃষ্টির গান শুনলে যেমন অনুভুতি হয় এটা তেমনই এক অনুভূতি, ঝমাঝম বৃষ্টির ছোঁয়া পুরাপুরি উপভোগ করালাম।
বৃষ্টির গানের সাথে। সৌরভ ভাই, জয় আর জিসান সুর মিলালো বৃষ্টির সাথে
“আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি
আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই
আমি অগ্নিগিরির কাছে জ্বলতে শিখেছি
আমায় আর জ্বালানোর ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই”
আমি আর টিপু যেহেতু গান জানিনা আমরাও একটা ছড়া পাঠ করে সামাজিকতা রক্ষা করলাম…
“আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেব মেপে
লেবুর পাতা, করমচা
যা বৃষ্টি চলে যা”
দুর থেকে দেখা যাচ্ছে অনেক লোক, ওটাই মনে হচ্ছে বিছনাকান্দি,আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের আসল ঠিকানা বিছনাকান্দিতে।নীল অবয়বের আকাশের সাথে ঘন সবুজের আকাশচুম্বী পাহাড়, পাহাড়ের সাথে মিতালি করে সাদা শুভ্র মেঘের কুণ্ডলী ঘুরঘুর করছে, আর পাহাড়ের বুক চিড়ে নেমে আসা ঝরনার পানি কলকল ধ্বনি করে পরছে পাথরে। সে ধ্বনি বাতাসে মিশে শাঁ শাঁ শব্দে কানে আসছে, আর পাহাড়ি ঝরনার পানিতে আমরা গা ভিজাচ্ছি। চারেদিকে পানির মধ্যে পাথরে পাথরে একাকার, ছোট বড় পিচ্ছিল পাথরে সাথে খড়-স্রোতের তালে তালে শুধু গা ভাসিয়ে দেওয়া যায়, একটু দাঁড়াতে বা চলতে গেলেই পা পিছলিয়ে চিৎপটাং। স্বচ্ছ পানিতে চলছে ডুবাডুবি খেলা। যে যাকে পারছে ডুবিয়ে নিচ্ছে।আজ যেন
“কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে”
আরে, আজ সে হারিয়ে যাওয়া মনে মনে নয়, একদম বাস্তবে, চোখের সামনে।
সবাইতো হারাবেই। এই মুহূর্তে আমার কোন অতীত সুখের বা দু:খের স্মৃতি মনে পরছেনা।আমাদের আয়-বুড়ো পোলাপাইনের শিশু সুলভ দুষ্টামি দেখে আশ-পাশের লোকজনও অবাক।কীসের আমরা? কে আমরা? সব বেমালুম ভুলে থাকলাম পানিতে ডুব দিয়ে আর পাহাড়ি ঝরনার পানি গায়ে মেখে। কে বলবে তোফায়েলের একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান আছে, গাফ্ফার আর সৌরভ ভাইয়ের একেবারে নিজস্ব সুন্দরী দু’খানা বউ আছে। আমি, জয়, টিপু আর জিসান নাহয় অবিবাহিত অবুঝ ছেলে আমাদের এমন ছেলে মানুষি মানায়।
ডুব দিয়ে কয়েক হাত লাফ দিয়ে শূন্যে ভেসে একটা ছবি তুলব। কিন্তু ডুব দিতে গিয়েই যত বিপত্তি, আমার চশমা হারিয়ে গেছে কয়েক হাত পানির নিচে, আমি চিৎকারকরে বলে উঠি, “ভাইরে, আমার চশমা হারাই গেছে, আমারে বাঁচাও”। এর পরেই সবাই মাছ মতো হাতড়িয়ে চশমা খুঁজতে লাগলো। আমার পাওয়ারী চশমার ব্যাপারেএকটা গল্প আমার বন্ধুরা প্রায় বলে আমার সাথে টিটকারি করে।
“আমি নাকি ১৯৭১ সালে যুদ্ধে থাকলে, আমার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা কোন বুলেট খরচ করতে হতোনা, শুধু চশমাটা খুলে রাখলেই চলতো”!! কথাটা আজ হারে হারে সত্যি প্রমাণিত হলো, কিছুক্ষণের জন্য চশমা হারিয়ে আমি পুরাই অন্ধের মত আচরণ করলাম। শেষ পর্যন্ত চশমা খুঁজে পেলো সৌরভ ভাই। শুধু কৃতজ্ঞতা বোধে কাজ হলোনা, কিছু খাওয়ানোর শর্তে চশমা ফেরত পেলাম। সবার ভি-সাইন দিয়ে ছবি তুলতেই বুঝা গেলো চশমা খুঁজে পাওয়ার আনন্দ শুধু আমার না, সবার।
অনেক হয়েছে,আর না। ভিজা কাপড়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়? আজকের দিনও শেষ এইবার আর রাতারগুল যাওয়া হলোনা। জিসান, টিপু আর আব্দুল গাফ্ফারের আপসোসেরও শেষ থাকলোনা।
তারপরে সন্ধ্যায় শাহজালাল(র) মাজার পরিদর্শন করে রাতের খাওয়ার খেয়ে ১০টার ট্রেন ধরলাম। ফার্স্ট ক্লাসের ট্রেনের সিটে বসে হেডফোন কানে গুজে দিতেই রাজ্যের ঘুম জড়ো হলো চোখের পাতায়। এক ঘুমেই উঠে দেখি, আমরা কমলাপুর স্টিশনে।
আবার চীর চেনা ঢাকায় এসে মনের পুরোনো দু:খের মাখামাখির অতীত গুলো এসে ভিড় করল। মনে হলো আবারশুরু হলো সেই দু:খের জীবন। তাতে কি, এত দু:খের মাঝেও একদিন যে বিছনাকান্দির প্রেমে দু:খ ভুলে থাকলাম তাও কম কিসের।
লেখা: রাশেদুল হায়দার
ছবি: সৌরভ
Leave a Reply