নাফাখুম জলপ্রপাত – নেটওয়ার্কের বাইরে একদিন

আজকে যাবো। কালকে যাবো। এই বর্ষায় যাবো। এমন করতে করতে এক ট্যুরের প্ল্যান চলে প্রায় দুই বছর ধরে। এর মধ্যে করোনা। লকডাউন। শাটডাউন। মাস্ক। স্যানিটাইজার ইত্যাদি ইত্যাদি পৃথিবীতে নতুন করে আগমন করেছে। অন্যদিকে নাই হয়ে গেছে অনেক পরিচিত মানুষ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-অনাত্মীয়। প্রতি বছর একটা জংলী ট্যুর দেয়ার ইচ্ছে থাকে। বড়সড় একটু গ্রুপ করে কোন দুর্গম ঝর্ণা বা গিরিপথ বা ঝিরিপথ ধরে বহুদূর…।

মাহমুদুল হাসান আমার খুব কাছের ছোট ভাই। তার ম্যানেজমেন্ট লেভেলের দক্ষতা ঈর্ষণীয়। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া তার নেটওয়ার্ক। কিছুদিন পরপর মেসেজ দেয় ভাই রেডি থাকেন। হা হা সরল হাসির ‘হাসান’ নামটাকে সার্থক করেছে। ছেলে-বুড়ো সবার সমান প্রিয় ‘হাসান ভাই’। ‘হাসান আমার ছোট ভাই’ এই রেফারেন্স ব্যবহার করেও আমি অনেক জায়গায় ভাব নিই। মিস্টার হাসান আমাদের ট্যুরের সিইও এন্ড হেড অব ম্যানেজমেন্ট।

ট্যুর ম্যানেজার, ব্যাচেলর আলামিন ভাই। উনার নামের সাথে ব্যাচেলর কথাটা বেমানান। হালকা ফর্সা, সুঠাম দেহী, আনুমানিক পাঁচ ফিট ছয় ইঞ্চির আলামিন ভাইয়ের চাল-চরিত্র ভালো। আপনাদেরকে ব্যাপারটা বলে রাখলাম! আলামিন ভাইয়ের জন্য ট্যুর বিষয়ক একটা কথায় খাটে, ‘ডেডিকেশন’। এতো ডেডিকেটেড একজন বড় মনের ম্যানেজার পেলে ট্যুরে খাই-দাই আর আনন্দ অনেকগুণ বেড়ে যায়।

বাবু ভাই, সহযোগী ম্যানেজার। অনেক খাটাখাটি করা পরিশ্রমী একজন মানুষ। আমাদের যাওয়া আশার টিকেট ম্যানেজ করার জন্য ঘুরেছেন কাউন্টার থেকে কাউন্টারে। আর ট্যুর মেম্বারদের সাপোর্ট করেছেন সর্বত্র।

সাঙ্গু নদীতে ডিঙ্গী নৌকা

সবার পক্ষ থেকে এই তিনজনকে বিশেষ ধন্যবাদ এবং অশেষ ভালোবাসা। যাদের কষ্টের বিনিময়ে আমরা বাকীরা টোটালি একটা রেডিমেড ট্যুর করেছি। এক গাড়ি থেকে উঠেছি, নেমে অন্য গাড়িতে উঠেছি। পথে নেমে খেয়েছি। যাত্রা বিরতিতে ছবি তুলেছি।

প্রতি ট্যুরে যাওয়ার আগে ট্যুর-মেটদের নিয়ে একটা টেনশন থাকে। মনের মত হবে কিনা? কেমন না কেমন হয়? আনন্দ মজা উপভোগ করবে কিনা? অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্ট সহ্য করবে কিনা? অন্য সদস্যদেরকে অগ্রাধিকার দিবে কিনা? ইত্যাদি বিষয়ক একটা চিন্তা এবারও ছিলো। কিন্তু এই চিন্তায় ভাটা পড়েছে যখন দেখলাম অন্যরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে যে, বড় ভাই আমাদের সাথে যাবে উনি আমাদের সাথে এই কষ্টের পথ চলতে পারবে কিনা? উনি না আবার আমাদের দলবদ্ধ-ট্যুরের আনন্দের বাধা হোন। সব ট্যুরমেট এতো এতো ভালো যে, আমি বরং বড় হয়েও তাদের থেকে বেশি ফাজলামো আর মজা করেছি।

এক ঝাঁক ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে এই ট্যুর। DESCO এর ইঞ্জিনিয়ার মহসিন ভাই। মহসিন ভাইয়ের মধ্যে গান গাওয়ার এক সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে ছিলো! চান্দের গাড়ির ঝাঁকির সাথে ওই প্রতিভা প্রস্ফুটিত হয়েছে। DPDC এর ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন আমার ক্লাসমেট প্লাস রুমমেট প্লাস সর্ব-ট্যুরের ট্যুরমেট সাবেক দুষ্টু ছেলে বর্তমানে ভালো ছেলে টিপু সুলতান। একমাত্র DSLR ক্যামেরার স্বত্বাধিকারী ছিলেন DPDC এর আরেক ইঞ্জিনিয়ার নাছির ভাই। যাকে আমরা সিঙ্গেল ছবি তুলার জন্য অনেক জ্বালিয়েছি। এতো দামি DSLR এর মালিক হওয়া স্বত্বেও নাছির ভাইয়ের কোনো ভাব ছিলো না! এই ক্যামেরা আমার হলেও আমি ভাব নিতাম।

DPDC’র আরেক জন ইঞ্জিনিয়ার হলেন রাহাত ভাই। আমার দেশি। সন্দ্বীপের লোক। ছেলেটা একটা মাশাআল্লাহ্ টাইপের আর কাজকর্মে সুবহানআল্লাহ। আরও ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ার বেলাল ভাই। বেলাল ভাই ফার্মের মুরগি না পাহাড়ি মুরগি এই বিষয় নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। হাসি-খুশির বিষয়ক উৎসাহ দিয়েছেন। সৌরভ ভাই হলেন একজন উদ্যোক্তা এবং ফাউন্ডার সপম্যাক্স (Sopmax)কোম্পানির। সপম্যাক্স চায়না থেকে মালামাল ইমপোর্ট করে। সপম্যাক্স (Sopmax) আমাদের ট্যুরের টি-শার্ট স্পন্সর করেছেন।

বরাবরের মত ছিলেন জয় ভাই। দৈনিক প্রথম আলোর আইটি ইঞ্জিনিয়ার। যিনি অনেক আগ থেকে ট্যুর বিষয়ক খবরাখবর নিতেন এবং অনেকটা ‘একটা সিট বুক করে রাখেন ভাই’ টাইপের। আমাকে প্রথম আলোর লোগো সম্বলিত একটা জার্সি এবং ট্রাউজার গিফট করেছেন। সর্বশেষ সংযুক্ত হলেন আমার দুই কলিগ রানা ভাই এবং সাদ্দাম। ভাই একটু দাঁড়ান আমি আসতেছি বলে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্যুরে যেতে রাজি হয়ে যান। আমি হুট করে বললাম আর উনি টুক করে রেডি হয়ে গেলেন। রানা ভাই ভাবী থেকে ছুটি নিয়েছে এই বলে, “রাশেদ ভাইও যাবে”! আর সাদ্দাম ছুটি নিয়েছে, “রানা ভাইয়ের সাথে যাবো”! কি শক্ত রেফারেন্স!

থানচি থেকে নাফাখুম যাত্রার পূর্বে

এখন আমি কার কথা বলে ছুটি নিই ভাবতেছে! সিলিং ফ্যানের স্পীড একটু বাড়িয়ে, দরজা-জানালায় পর্দা টেনে, কাঁচের ভঙ্গুর সকল জিনিস হাতের কাছ থেকে দূরে রেখে ওকে বললাম, এইটা নতুন নয়! এমন ঘটনা বরাবরই হয়! যে পরিমাণ প্রেশারে থাকি এমন ঘটনা ঘটায় স্বাভাবিক! দুইদিনের জন্য ঢাকার বাহিরে যাচ্ছি! আমার ছোট ভাইরা কোনও প্রকারেই আমাকে ছাড়া যেতে রাজি নয়! তাদেরকে হতাশ আমি করতে পারি না! তাই যেতে হচ্ছে, এক রাতে যাবো, মাঝে আরেক রাত এর পরের রাতে ফিরে আসবো, ইনশাআল্লাহ! আর আসার সময় দেখি, পাহাড়িদের বানানো বিভিন্ন থ্রী-পিচ সহ তাঁতের কাপড়-চোপড় বান্দরবানে পাওয়া যায়! সময় পেলে ওই মার্কেটে জামুনে… কিছু একটা কিনমুনে…!

হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দ। ওই সময় জি-বাংলা চ্যানেলে শ্রীময়ী চলতেছিলো! এই বজ্রপাত সেই সিরিয়ালের। শ্রীময়ীর আগের স্বামীর সাথে বনিবনা হচ্ছিল না! শুধু সারাক্ষণ ঝগড়া করে। আমি বললাম, এই লোকটার সাথে না শ্রীময়ী খালার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, তাহলে হে আবার এইহানে ক্যান! এই বদ লোকটাকে শ্রীময়ী খালার একদম প্রশ্রয় দেওয়া উচিত না!

পামে কাজ হলো! যেহেতু হাসি দিয়েছে সেহেতু আপাতত: গ্রিন সিগন্যাল।

এবার আম্মার সম্মতি মিললেই ভিসা ফাইনাল। আম্মা পান খাচ্ছে। হাকিমপুরি জর্দা। ঝিনুকের চুন আর সাথে কাঁচা সুপারি। আমি আম্মার পাশে বসলাম। আমি বললাম, দেশে সব কিছুর এত নকল বের হয়েছে যে, হাকিমপুরি জর্দার ঘ্রাণও আগের মত নাই। এরপর আম্মার ঔষধের বক্সে কি কি ঔষধ আছে দেখে নিলাম। ঔষধ খাওয়ার বিধিনিষেধ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য বকাবকি সেটা আজ করা যাবে না। আপনার ডায়াবেটিস বেশি দেখে আরও আমি এতদিন ঈগলু আইসক্রিম আনিনি। দেখি কাল আবহাওয়া যদি ভালো থাকে এক বক্স আইসক্রিম আনবো। আমার নিজেরও খেতে ইচ্ছে করছে। আম্মা বলেই ফেলছে, চকলেটেরটা আনিস না আরেকটা সাদা আছে সেটা আনিস। মানে ভ্যানিলা। এবার কথাটা বলা যায়। আম্মা অফিসের কাজে এইবার মনে হয় বান্দরবান যাওয়া লাগতে পারে। তবে আমি যেতে চাচ্ছি না। পাহাড়ি পথ। রাত জেগে আসা যাওয়া। এতো কষ্ট করে কে যেতে চায় বলেন? তারপরেও অফিসের কাজ বলে কথা! এমন একটা টাটকা মিথ্যা বলতে আমি অনেকটা বাধ্য হয়েছি। আল্লাহ্‌ মাপ করুন!

কিছু অসাধারণ ভাই-ব্রাদারদের সাথে নিয়ে আমরা ১৩ জন ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ফি-আমানিল্লাহ্!

বাস থেকে নেমে সকালের নাস্তা শেষে এবার ভ্রমণের মূল পর্ব। এখন গন্তব্য বাংলাদেশের সর্ব পূর্বের উপজেলা থানচি। এর আগে নীলগিরি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তখন থানচির ওই রাস্তার দিকে চেয়ে ছিলাম। কখন যাব? আজ সে আশা পূর্ণ হতে যাচ্ছে।

থানচি যেতে প্রায় ৮০ কি.মি. রাস্তা যেতে হবে চান্দের গাড়ি করে। যেতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা। আর পথে পথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বিজিবির চেক-পোস্ট। পথে পথে চেকপোস্টে দেয়ার জন্য আমাদের প্রতিজনের এনআইডির মোট ছয়টি ফটোকপি লেগেছিলো। অনুমতির জন্য থানচিতে নেমে থানচি থানায় হাজিরা দিতে হয়েছে। থানায় আমাদের একটি গ্রুপ ছবি তুলে রাখেন দায়িত্বরত একজন পুলিশ। এতেই বুঝা যায় আমরা কোন জায়গায় যেতে চলেছি। এতো ফরমালিটিজ আর কোন ট্যুরে আমি পাইনি।

এখন গন্তব্য নাফাখুম। থানচি থেকে ছোট নৌকায় করে সাঙ্গু নদী হয়ে প্রায় ১.৩০ ঘণ্টা যেতে হবে রেমাক্রি। ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা। সর্বোচ্চ পাঁচ জন বসতে পারে। সবাই নৌকার মাঝ বরাবর করে বসতে হয়। দাঁড়ানো বা ডানে-বামে কাত-চিত বা নড়াচড়ার কোন সুযোগ নেই। এই নৌকায় যাওয়ার সময়ের লাঞ্চ সারলাম। যোহরের কসর নামাজ আদায় করলাম। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ছোট নদী। বহমান নদী। যাওয়ার সময় স্রোতের উল্টো দিকে যেতে হয় বলে সময় আসার তুলনায় বেশি লাগে।

এবার রেমাক্রি গিয়ে নৌকা বদল। এখন উঠতে হবে আরেক নৌকা। এই নৌকায় যেতে সময় লাগবে প্রায় ৪০ মিনিটের পথ। এই নৌকা থেকে নেমে পাহাড়ি ঝোপঝাড় দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হবে আরও ১৫ মিনিট। এইসব ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ মাত্রই একটু গাঁ শিরশির করে। মনে হয় এই না কেউ সামনে এসে বলবে,”এই দাঁড়া, কি আছে দিয়ে দে”! অথবা সামনে একটা বাঘ বা ভাল্লুক এসে পথ আগলিয়ে দাঁড়াবে সকালের নাস্তা সারার জন্য। যাই হোক ভয়ের কিছুই নেই এসব শুধু মনের কল্পনা।

তারপর আবার আরেকটি নৌকায় করে যেতে হবে নদীর ওই পাড়। এরপর পায়ে হাঁটা আবার ৩০ মিনিট। এই পথটিই হাঁটা খুব যে সহজ তা না। পিচ্ছিল আর উঁচুনিচু রাস্তা। যদি বৃষ্টি হয় তাহলে এই পথে যাওয়ার কষ্টকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিবে। এবং এটি একটি দেখার মত একটা রাস্তা। সত্যি বলতে কি? এমন রাস্তা আমাদের জন্য নতুন নয়। বরং আমরা আরও বেশি পথ পায়ে হেঁটে যাবো। আর সামনে ঝিরি পথে এক কোমড় পানি থাকবে। আমরা সেই পানি পথে হেঁটে যাবে। জোঁক ধরার ভয় থাকবে। পিছলিয়ে পরে যাবো। এমন কঠিন চিন্তা করেই আমরা গিয়েছি। কিন্তু তার কিছুটা অনুভব পেলেও পুরোপুরি এমন না।

নাফাখুম জলপ্রপাত

তারপর পৌঁছলাম সেই কাক্ষিত নাফাখুম জলপ্রপাত। ওই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে নাফাখুম জলপ্রপাত দেকে সঙ্গিসাথীরা একটু হতাশ হয়েছেন। কারণ, আমাদের মনের ছকে যে ঝর্ণা এঁকে এনেছি সেটার তুলনায় একটু ছোট এবং এই ঝর্ণা শুধু দেখার জন্য এটাতে নেমে গোসল করা যায় না। ঝর্ণাতে গোসল দিব বলে যে সপ্তাহ দশ দিন অপেক্ষা করেছিলাম সেটার জন্যই একটু হতাশ। আর আমাদের প্রস্তুতি ছিলো সর্বোচ্চ লেভেলের। তাই আরেকটু কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বড় কোন ঝর্ণায় গিয়ে গা ভিজাবো এটাই তো আশা। তবে এই আপসোস পুষিয়ে দিয়েছে আশপাশের পরিবেশ। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক সাথে ঝর্ণার জুমজুম আওয়াজ। রাতের নিস্তব্ধতার সাথে একদম খাপ খেয়ে একাকার। চারিদিকে তাকালে মাত্র কয়েকটি সৌর-বিদ্যুতের লাইট ছাড়া আর কিছুই নাই। গাঢ় অন্ধকার আর নিস্তব্ধতায় এখানকার উপভোগ্যের মূল বিষয়। আপনি যদি ভবঘুরে, আনমনে আর উদাস মনের হয়ে থাকেন তাহলে তো আর কথাই নেই। এই পরিবেশ স্মরণ করিয়ে দিবে অতীত কোন সুখ স্মৃতির। আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে নতুন কোন পথ চলার প্রত্যয়ে। দু:খকে ভুলে থাকার এই তো সময়। এই পাহাড়ি গহিন বনবাসের সার্থকতাই তো এখানে। এখানে এসেও যদি আপনি ব্যবসায়িক আলাপ করেন। পরিবার/অফিস নিয়ে টেনশন করেন তাহলে এই পরিবেশ আপনাকে বলবে ভাই তুমি যাও গিয়ে কোন ফাইভ-স্টার হোটেলে থাকো।

নাফাখুম থাকার এক মাত্র গ্রাম!

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়নি, এখানে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। নেই মানে নেই। মানে নেটওয়ার্ক সিগন্যালের আইকন লাল ক্রস হয়ে আছে। থানচি থেকে নৌকায় চড়ার ১০ মিনিটের মাথায় আপনি মোবাইল নেটওয়ার্ক হারাবেন। এটা একটা সাবধানতা। আমার মত কেউ ভুর করবেন না। আমি বাসায় বলিনি যে আমি আগামী একদিন নেটওয়ার্কের বাহিরে থাকব। যার ফল স্বরূপ আমাকে এবং পরিবারকে পুরো একদিন টেনশনে থাকতে হয়েছে।

তবে নেটওয়ার্ক-বিহীন জীবনকে উপভোগ করার এর থেকে মোক্ষম সময় মনে হয় আর কোন ভ্রমণ এলাকায় নেই। তাই যত বেশি প্রকৃতি প্রেমী, ভাবুক আর আনমনে হয়ে ঝর্ণার সাথে মিতালি করা যায় ততই ফায়দা। যেখানে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা গড়ে মোবাইল ব্যবহারের অভ্যাস সেই অভ্যাসবশত এখন আনমনে হয়ে মোবাইল হাত নিলে ছবি তোলা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। না কোন কল করা যাচ্ছে না সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা যাচ্ছে। নেটওয়ার্কে ফিরে তাই আমরা অনেকটা মজার ছলে বলেছিলাম, ফেসবুক কোম্পানি কি আছে? নিশ্চিত তাদের শেয়ারে দামের পতন ঘটেছে। আমাদের মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারকারী ফেসবুক করর্পোরেশন একদিনের জন্য হারালো।

ম্যানেজার আলামিন ভাই ছোট্ট ঘরে জরুরী কাজে যাচ্ছেন!

সত্যি কথা বলতে কি রাতের থাকার ব্যবস্থা এতটাই প্রাকৃতিক এতটাই প্রাকৃতিক যে, সত্যিই মন ভরে গেলো। একটা পাহাড়ের উপর দুইতলা বিশিষ্ট বাঁশের ঘর। শক্ত বাঁশের ছাউনির উপর একটা করে পাটির বিছানা। শোয়ার জায়গা থেকে ঝর্ণার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনা যায়। জানালা দিয়ে দেখা যায় বনের ভিতর ছোট্ট টয়লেট। এই টয়লেট নিয়েই সবার যত বিপত্তি। সবার এক কথা; ঢাকা যাওয়ার আগেই যাতে এই ছোট্ট ঘরে যাওয়া না লাগে সেই কামনা সবার মনে। যারা বেশি নাক ছিটকিয়েছে তাদেরই ওই ছোট্ট ঘরে বেশি যাওয়ার জরুরী প্রয়োজন পরেছে। সবাইকে এই ছোট্ট ঘর বিষয়ক একটা মোটিভেশন দিলাম, ভাইয়েরা আমার! দেখুন, আমরা এসেছি পাহাড়ি দুর্গম এলাকায়। যেখানে আমরা মশার কামড়ে রাত্রি যাপন করব, পাহাড়ি বন-জঙ্গলে ঘুরেফিরে থাকবো। এমনকি খাবারদাবার না পেলে পাহাড়ি ফলমূল খেয়ে দিনানিপাত করব। এখানে নিশ্চয় আমরা ইংলিশ হাইকমোড আশা করে কেউ আসিনি।

ভাই ঠিক বলেছে। সহমত ভাই বলে সবাই আমার কথায় সায় দিলো।

কোন জাঁদরেল কবি হলে হয়তো “চাঁদনি রাতে বদনা হাতে” টাইপের কোন কবিতা লিখে ফেলতেন।

রাত নয়টা পর্যন্ত ঝর্ণার পাশে চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে হোটেলে ফিরেছি। জি! এটাই এখানকার হোটেল। মুরগি,আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে রাতের ভাত খেয়ে আরেকটা বিশাল আড্ডার আসর জমিয়ে তারপর ঘুম। টানটান উত্তেজনায় ঘুমকে উপভোগ করলাম। এমন নির্মল ঘুম আর হয় না। হতে পারে গতদিনের জার্নির ক্লান্ত শরীর। খুব ভোরে উঠে ঝর্ণার ব্রিজে দাড়িয়ে হেলেদুলে ফটো-সেশন হলো। সকালের নাস্তা সেরে সকাল ৮ টায় ফিরতে পথ রেমাক্রির উদ্দেশ্যে বের হলাম।

রেমাক্রির ঝিরি ঝর্ণা গোসল করার জন্য খুব ভালো একটা জায়গা। ঝিড়ি ঝর্ণায় স্রোত আছে। পানিও এতো বেশি না আবার কমও না। চারিদিকে পাহাড়ে বেষ্টিত জায়গায় গোসল। আহা! তবে পিচ্ছিল জায়গা একটু এদিক-ওদিক হলেই চিতপটাং। তাই হাড়গোড় ভাঙ্গার আগে সাবধান হওয়া আবশ্যক। পিচ্ছিল ঝর্ণার বিপদ ঠেকাতে থানচি থেকে রাবারের জুতা কিনেছিলাম সেটা এখন কাজ দিচ্ছে পুরোদমে। জুতা কিনার পয়সা উসুল। নাফাখুম থেকে ভালো থাকা খাওয়ার জন্য চাইলে তারা রেমাক্রিতে রাত্রি যাপন করতে পারেন। আপনাদের কাক্ষিত সেই হাইকমোডের ব্যবস্থা সহ এখানে বেশ কিছু কটেজ আছে।

রেমাক্রির পিচ্ছিল ঝিরি ঝর্ণা

রেমাক্রি থেকে ফেরার পথে তিন্দুতে রাজা পাথর নামলাম। জায়গাটা সুন্দর। বড় বড় পাথর নদীর উপরে বিছানো। মনে হয় কোন এক কাল বৈশাখীর রাতে এগুলো পাহাড় থেকে আঁচড়ে পরেছে। ছবি তোলার জন্য একটা ভালো জায়গা।  বিশেষ করে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার এখানকার ছবি দিয়ে পরিবর্তন করতে পারেন। শিওর থাকেন লাইক বেশি পাবেন।

থানচির কাছাকাছি আসতেই মোবাইল মেসেজের টিংটিং। মহামান্য হোম মিনিষ্ট্রি থেকে মেসেজটি এসেছে। অভিমানী এবং চিন্তাযুক্ত ম্যাসেজে লেখা, “স্যার, সময় পেলে কল দিয়েন! টেনশনে আছি! ঘরেতে চাল নেই!”

গলা খাকি দিয়ে ভয়ে-ভয়ে কল দিলাম, ওই পাশে রিং হচ্ছে। এই ধরবে ধরবে ভাব। মনে হয় কোন বড় স্যারকে ফোন দিচ্ছি গতকাল অফিসে যেতে পারিনি তার কোন কৈফিয়ত দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে। বুকের মধ্যে ড্রামের বাড়ি। দ্রিম.. দ্রিম..।  রিং বন্ধ হয়ে অপর পাশ থেকে প্রথম কথা, জী বলেন? এরপর….! থাক!

থানচি থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে চান্দের গাড়ি মাঝে বোনাস নীলগিরি। নীলগিরি যারা আগে যায়নি তাদের অনুভূতি নীলগিরির ব্যাপারে বেশ দারুণ। যেটা আমার প্রথমবার হয়েছিলো। তবে নীলগিরির প্রধান আকর্ষণ হলো, মেঘ। যেটা দেখতে খুব ভোরে যেতে হয়। মেঘ দেখা যদিও মিস কিন্তু শুধু নীলগিরিও কম কিসের। সবার একটা কথা। দারুণ। দারুণ। ওয়াও! ওয়াও!

বান্দরবান ফিরে নান-গ্রিল খেয়ে রাতের বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা। পিছনের সিট হওয়ায় ফিরতি যাত্রা আরামদায়ক না হলেও কতশত সুখ স্মৃতি নিয়ে ফিরছি। মনের গহিনে পাহাড়ি ঝর্ণার যে ছবি এঁকেছি সেই ছবি দেখে অনেকদিন সুখে থাকা যাবে।

এই পৃথিবী হলো মুসাফির খানা।
এখানে ছদ্মবেশে চলতে হয় এদিক ওদিক।
সাথে থাকে ছোট একটা পুটলা।
রাত কাটে কোন অজানা অচেনা পরিবেশে।
এখানে বিশ্রাম নিতে হয় যাত্রা পথে।
আর ঘরে ফিরতে হয় পরবর্তী যাত্রার প্রস্তুতির জন্য।

লেখা: রাশেদুল হায়দার

২৭ অক্টোবর, ২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Recent Post

শুভ জন্মদিন ২০২২

আজ আমার তেত্রিশ মতান্তরে পঁয়ত্রিশতম শুভ জন্মদিন! (বয়সে করোনাকালিন হিসেব বাদ দেয়া হয়েছে) ছবিটি আনুমানিক ২০ বছর আগের হারিকেন জমানার। ছত্রিশ ফিল্মের কোডাক ক্যামেরার। মেঘে মেঘে বয়স তো আর কম হলো না। সেই ১৫ টাকা সের চাল সময়কার ছেলে আমি। ৪০ টাকা নিয়ে বাজারে যেতাম। এর মধ্যে মাছ-তরকারি, মুদি সদায় সহ দুই টাকা বাঁচিয়ে .....

বই: প্রোডাক্টিভ মুসলিম

বইটি পড়ে কিছু ব্যাপারে আচার্য হয়েছি। বইটি হাতে নিয়ে পড়ার আগে মনে করেছিলাম, এর ভিতরে লেখা থাকবে শুধু কাজ আর কাজ। কিসের ঘুম, কিসের বিশ্রাম আর কিসের অবসর। হয়তো বলা থাকবে, এই দুনিয়াতে কি শুধু ঘুমাতে আসছেন। শুধু কাজ করেন আর অন্য কিছু নয়। পরবর্তীতে ঘুমের উপর চ্যাপ্টার পড়ে আরও বেশি আচার্য হয়েছি যে, .....

বই: ইন দ্য হ্যান্ড অব তা-লে-বা-ন

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। মঙ্গলবার। নিউইয়র্ক-বাসীর সকালটা শুরু হয় অন্যান্য দিনের মত! সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা নিউইয়র্কের লোকজন খুব সকালে উঠে যার যার অফিস শুরু করেছে। প্রতিদিনকার সকালের মত হয়তো কেউ কেউ চা-কপি দিয়ে মাত্র অফিস ডেক্সে ওইদিনের মত নিজেকে সেট করে নিচ্ছে। পৃথিবীকে নাড়া দিতে যাচ্ছে এমন কোন ঘটনা ঘটতে চলেছে তখনও এই .....

বই: ফজর আর করব না কাজা!

আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম! মাত্র ফজরের আজান হয়েছে। সামনের বাসার আঙ্কেলের বড় গেটের তালা খোলার খটখট আওয়াজ। তারপর আমার মোবাইলের এক নাম্বার এলার্ম ভেজে উঠলো। একরাশ বিরক্তিসহ এলার্ম বন্ধ করলাম। এই আলতো ঘুমের এমন ঝনঝন তালা খোলার শব্দ আর এলার্মের এমন ভিট-ঘুটে আওয়াজ সত্যিই বিরক্তিকর ছিলো। তারপর কোন রকম উঠে দায়সারা ভাবে নামাজ ঘরে .....

বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ রিভিউ: এ আমি কি দেখলাম?

অফিস থেকে মনে হয় একটু তাড়াহুড়া করেই বের হয়েছি। আজকে বাংলাদেশের চির প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলা। কয়দিন আগেও এই অস্ট্রেলিয়াকে মিরপুরের মাঠে আমরা কচুকাটা করেছি। সেই হিসেব মতে আজ একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই উপভোগ করবো। টানটান উত্তেজনা থাকবে। বাংলাদেশ হাড় কাঁপানো ব্যাটিং করবে। মাঠ কাঁপানো ফিল্ডিং করবে। টানটান করে বাউন্ডারি হাঁকাবে। দর্শক সাড়ি থেকে বাংলাদেশ! .....

নাফাখুম জলপ্রপাত – নেটওয়ার্কের বাইরে একদিন

আজকে যাবো। কালকে যাবো। এই বর্ষায় যাবো। এমন করতে করতে এক ট্যুরের প্ল্যান চলে প্রায় দুই বছর ধরে। এর মধ্যে করোনা। লকডাউন। শাটডাউন। মাস্ক। স্যানিটাইজার ইত্যাদি ইত্যাদি পৃথিবীতে নতুন করে আগমন করেছে। অন্যদিকে নাই হয়ে গেছে অনেক পরিচিত মানুষ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-অনাত্মীয়। প্রতি বছর একটা জংলী ট্যুর দেয়ার ইচ্ছে থাকে। বড়সড় একটু গ্রুপ করে কোন .....

All Post