প্রলয়ংকারী ২৯ এপ্রিল, ১৯৯১
প্রলয়ংকারী ২৯ এপ্রিল, ১৯৯১ জেগে থাকা কিছু স্মৃতি
২৯ই এপ্রিল দিনের বেলা, প্রতিদিনের মত এদিনও ছিল স্বাভাবিক, সারাদিন ধরে যে যার মত কাজ করছে । মোশারাফ ভাইয়ের বাপ, আমার তালই, সারাদিন খেত-খামারে কাজ করে ঘরে ফিরেই প্রতিদিনের মত উচ্চস্বরে-সুর করে দোয়া-দরুদ পড়ছেন । বাড়ির আরেক জেঠা, বোরহান ভাইয়ের বাপ, সন্ধ্যায় গরু-ছাগল গোয়ালে বেঁধে প্রতিদিনের মত বারান্দায় বসে সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছেন, আর মাঝে মাঝে হাঁক দিচ্ছেন, “ও মাস্টার, রেডিও-তে কি বলে”। মাস্টার ভাই হল, আমাদের বাড়ির BBC, ওনার কানের কাছে সারাক্ষণ রেডিও থাকে, সব আপডেট সংবাদ আগে ওনার কাছে আসে ।
এইরকম ১০ নাম্বার বিপদ সংকেত, দিনভর দমকা বাতাস, মেঘে ঢাকা আকাশের গুমোট অন্ধকার, গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি আর কান ফাটানো বজ্রপাত, এসব আর নতুন কি! এইরকম-ত প্রায় হয় । সন্দ্বীপের মানুষের কাছে, আমাদের কাছে এই ৯-১০ নাম্বার বিপদ সংকেত কোন ব্যাপারই না! এসব চীর চেনা । এই ভেবে নিরাপদ আশ্রয়ে কেউ গেলনা । আমি ও আমার ছোট আপা স্বাভাবিক ভাবে রাতে পড়তে বসলাম, পাশে আম্মা হারিকেনের আলোয় কোরআন পড়ছেন । এদিকে দমকা বাতাসের জোর যেন আরও বেগবান হতে লাগল, আস্তে আস্তে সবকিছু খারাপ হতে লাগল, বজ্রপাত, বিদ্যুৎ চমকানো, ঝমাঝম বৃষ্টি সবকিছু আকাশ-বাতাসকে ভারী করে দিচ্ছে । বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা সাথে বজ্রপাত, ঘূর্ণি বাতাসের সাথে সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসছে পাহার সম উঁচু রাক্ষসে জলোচ্ছ্বাস, এত ভয়াল কিছু ঘটতে যাচ্ছে তখন পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি।
আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়, আমি জানিনা কেমন করে ওই ভয়াল রাতের কিছু স্মৃতি আমার এখনো মনে জেগে আছে।
রাতের আকাশ ভেঙে যে বৃষ্টি ঝরছিল ওই বৃষ্টি ফোঁটা ছরা গুলির মত টিনের চালে পরছিল, দমকা বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ মনে হচ্ছে এই বুঝি সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে, ঘর বাড়ির চাল বাতাসের ধাক্কায় মট-মট শব্দ করছে, আমাদের ঘর সহ বাড়িতে ৬ টি ঘর, ঘরের কট-মট শব্দে আর এদিক-ওদিক দোলানো দেখে এরই মধ্যে চার ঘরের মানুষ আমাদের ঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছে, বাকি করিমদের নতুন ঘর, গত কয়েক মাস আগে এই ঘর দেয়া বলে ওদের ঘরের প্রতি আস্থা ছিল সবার, কিন্তু সেই ঘরও একসময় কট-মট করে ভেঙ্গে পরার উপক্রম, তাড়াহুড়া করে ওই ঘরের সবাই আমাদের ঘরে এলো । জলোচ্ছ্বাসের পানি ততক্ষণে উঠান ভরে আমাদের ঘরের মেঝেতে, মুহূর্তের মধ্যেই পানি বেড়ে এখন আমাদের পালঙ্কের (খাট) ছুঁই-ছুঁই, আমি ও আমার ছোট আপা খাটের উপরে দাদির কোলে বসা, যখন পানি খাটের উপর উঠে গেল একটা টেবিল খাটের উপর দিয়ে আমরা ছোটরা আর বয়স্কদের ওই টেবিলের উপর রাখা হলো, সাথে কয়েক মাসের শিশু করিমও ছিল । আমাদের বড় ঘরের সাথে আরও দুইটা ঘর ছিল ওই ঘর দুটাকে আমরা আলগা ঘর (আলাদা ঘর) বলতাম, এরই মধ্যে ওই দুই ঘর বাতাসে পরে গিয়েছিল, আর আমাদের বড় ঘর, যে ঘরে এখন আমরা আছি সেই ঘরও নড়ছিল এদিক-ওদিক করে, আর আমাদের এই ঘর ভেঙে পরলে যে সবার মৃত্যু নিশ্চিত তা সবারই জানা ছিল, কারণ ঘরের পেছনে ছিল আমাদের বড় পুকুর, ঘর ভাঙার পর স্রোতের টানে সবাই ওই পুকুরে পরবে । সবার চিৎকার, চেঁচামেচি আর আল্লাহ আল্লাহ জিকির । বড় দড়ি দিয়ে ঘরের এই মাথা ওই মাথা টানা দিয়ে বেঁধে নেওয়া হলো, যাতে হেলে না পরে । আম্মা হারিকেন কে ওনার গায়ের শাড়ি দিয়ে ডেকে রেখেছে যাতে বাতাসে হারিকেন নিবে না যায়, আর কোন আলো নেয় হাতের টস লাইট ছাড়া, অনেকের টস-লাইটের কাঁচ ভেঙে গেছে অনেক আগেই । তখন আমাদের ঘরে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২৫-৩০ জন লোক হবে, সবাই এক রুমের মধ্যেই জড়ো হয়ে এক-বুক পানিতে দাঁড়িয়ে আছে, সবাই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, শুধু আমাদের ঘরই ভরসা, এইভাবে আল্লাহর অশেষ রহমতে রাত শেষে সকাল হল । সকালে যা দেখলাম তা যেন রাতের ভয়াবহতাকেও হার মানিয়েছে, আমাদের উঠানে বাড়ির ঘর-দোর, চাল, আসবাবপত্র পুরো বাড়িতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, অনেক দুর থেকে আসা আমাদের স্কুলের বেঞ্চও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সমস্ত বাড়ি জুড়ে । আমাদের আলগা ঘরের টিন-বেড়া গিয়ে পরেছে পাশের বাড়িতে, আমাদের ঘরের পাশের ডোবাতে লাশ, ওই দিকে খবর এলো আমার নানি মারা গেছে, আম্মা কাঁদতে কাঁদতে নানির লাশ দেখতে যাচ্ছে, আর আমি জানালা দিয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদছি, নানাদের ঘরের সবাই জলোচ্ছ্বাসের সময় তাড়াহুড়া করে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় নানি-যে ঘরে ভুলে রয়ে গেল তা কেউ খেয়ালই করেনি, নানির এই করুন মৃত্যুর আক্ষেপ এখনো আমার নানা বাড়ির লোকদের কাঁদায় । আমার মামিও কারেন্টের খাম্বার তারে ঝুলে বেঁচে ছিলেন। সকালে আমাদের ঘরের উপর একটি লাল টেবিল ক্লথ বড় বাঁশ দিয়ে ঝোলানো হল যাতে ত্রাণের হেলিকপ্টার আমাদের বাড়ি লক্ষ করে ত্রাণ ফেলে ।
ওই রাতের বিধ্বংসী তাণ্ডবলীলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছিল, চারেদিক যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বিরান মৃত্যুপুরীতে মত হয়ে গেল। কোথাও মানুষের মৃত দেহ গাছের উপর ঝুলে আছে, কোথাও বাচ্চা কে বুকে জড়িয়ে মায়ের লাশ । পথের পাশে এখানে-সেখানে মানুষের লাশ । পুকুরে গুরু-ছাগল অন্যান্য পশু-পাখির মৃত দেহ কচুরিপানার মত ভাসছে । নদীর ট্রলার, নৌকা এমনকি লঙ্গর করা বড় জাহাজ পর্যন্ত মানুষের ঘর বাড়ির উপর উঠে এসেছে, রাস্তা জোরে উপড়ে পরা গাছ, ঘর-বাড়িগুলো দুমড়ানো-মোচড়ানো, আর পশু পাখির মরা পচা দুর্গন্ধ বাতাসকে ভারী করে তুলচ্ছিল। সব দিকে ছিল পানিতে থয়-থয়, ওই রাতে হাজারো মানুষ হারিয়েছে তাদের আপনজনকে, মা হারায় সন্তানকে, স্বামী হারায় স্ত্রীকে, ভাই হারায় বোনকে। অনেক পরিবার আছে যাদের গোটা পরিবারই হারিয়ে গেছে এই জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের অতল গহ্বরে, যাদের লাশ পর্যন্ত স্বজনরা খুঁজে পাইনি, যার দু:খ বেদনায় এখনো ডুকরে কাঁদছে কোন মা, কোন সন্তান, কোন স্ত্রী ।
১৯৯১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের ২৪ বছর অতিবাহিত হলেও দুর্যোগ মোকাবেলায় নেয়া হয়নি সন্দ্বীপ উপকূল-বাসীর জন্য কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ । সন্দ্বীপের চারপাশে নির্মাণ করা হয়নি মজবুত কোন বেড়িবাঁধ । সাইক্লোন শেল্টারের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল, কোথাও কোথাও সাইক্লোন শেল্টার সাগর ও নদী ভাঙ্গনের হারিয়ে গেছে, বিদ্যমান সাইক্লোন শেল্টারগুলোও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী । বর্তমান রাজনৈতিক নেতা, বিত্তশালী ও সমাজ সেবকরা যদি এসব দিকে খেয়াল করে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে না আসেন, তালহে আবার কোন ২৯ই এপ্রিল, ১৯৯১ এর ভয়াল গ্রাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে সন্দ্বীপ-বাসীর, আল্লাহ আমাদের সকল ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আকস্মিক দুর্দশা, আল্লাহর অবাধ্যতার রোষানল থেকে রক্ষা করুন । আমিন ।
Leave a Reply