বই: দ্যা রিভার্টস – ফিরে আসার গল্প

‘দ্যা রিভার্টস: ফিরে আসার গল্প’ বইটির পড়তে গিয়ে চিন্তার সাগরে ডুবে গেলাম। অথৈ পানিতে হাতড়াচ্ছিলাম নিজের জীবনকে। কত শত ভাবনা খেলে গেলো নিজের মধ্যে। জীবন মানে কি? জীবনের উদ্দেশ্য কি? শুধু খাচ্ছি-দাচ্ছি চলছি ফিরছি। এটাই কি জীবন হতে পারে?

এই বইয়ে ১১জন মানুষের ইসলাম ধর্মে প্রত্যাবর্তন করার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে সাংবাদিক, খ্যাতনামা টিবি ব্যক্তিত্ব, কেউ ডাক্তার কেউ সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এমন কি ছিলেন খ্রিষ্টান পাদ্রী, বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত পণ্ডিত এবং বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা নিয়ে গর্ব করা ভারতীয় যুবক। সবাই নিজ নিজ জায়গায় অর্থ-বিত্তে সফল ব্যক্তি ছিলেন।

জীবনের যশ খ্যাতি, এত-এত ধন-সম্পত্তি, আরাম আয়েশ সহ বাহ্যিক জীবনের সব কিছু থাকা সত্ত্বেও সবাই কিসের শূন্যতায় ভুগছিলেন? কেন তারা আরাম বিছানায় ঘুমিয়ে শান্তি পাচ্ছিলেন না? কেন তারা তাদের সুস্বাদু খাবার-দাবার, আলিশান বাড়ি ঘরে থেকেও তৃপ্ত হচ্ছিলেন না? কিসের টানে তারা বেছে নিয়েছেন কষ্টের জীবন? চ্যালেঞ্জ করেছেন জীবনকে? চ্যালেঞ্জ করেছেন প্রতিকুল পরিবারকে, বিরুদ্ধবাদী সমাজ কে? গল্পে গল্পে সেসব কথা এই বইয়ে বলা হয়েছে।

জন্ম সূত্রে মুসলমান হওয়া আর একটু একটু জেনে বুঝে মুসলমান হওয়া এক কথা নয়। আমার বাবা মুসলমান তাই আমিও মুসলমান। আমি গরুর গোস্ত খাই, আমি শুক্রবারে নামাজে যাই, কুরবানির ঈদে কুরবানি দিই। শুধু এতটুকুতেই ঈমানের দাবী পূরণ হয়ে যায়না। খাঁটি মুসলমান বা পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হতে গেলে পুরো জীবনকেই ইসলামের রঙে রাঙাতে হয়। কারণ ইসলাম হলো, পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।

খাঁটি মুমিন বান্দা হতে গেলে কুরআন বুঝতে হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হয়। কুরআন কি অর্থ সহ কখনো পড়েছি? আল্লাহ কি বলতে চেয়েছেন তা কি কখনো জানতে চেয়েছি? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কি পড়ি নিয়মিত? মানুষ কি বুঝতে পারে আমার চাল চলনে কথা বার্তায় আমার লেনদেনে আমি একজন মুসলমান? আমার ধর্মে ঘুষ খাওয়া নিষেধ তাই আমি ঘুষ খাই না। আমার ধর্মে সুদের লেনদেন নিষেধ তাই আমি সুদের লেনদেন করিনা। আমার ধর্মে মদ খাওয়া হারাম তাই আমি মদ খাইনা। আমার ধর্মে পরিবার পরিজনের যেমন হক আছে তেমনি প্রতিবেশীর হক আছে, আত্মীয়স্বজনের হক আছে। আমি এসব হক আদায় করে চলি কারণ আমার ধর্ম এমন করতে বলেছে। না করলে আমি আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এমন অনুভূতি কি আমার মধ্যে আছে?

বইটি পড়তে পড়তে নিজের মধ্যে এসব আত্ম-জিজ্ঞাসাগুলো বিবেকে কড়া নাড়ছিল।

আমি যদি মুসলমান পরিবারে জন্ম গ্রহণ না করে অন্য কোন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে জন্মগ্রহণ করতাম তাহলে সব ধর্ম কর্ম যাচাই বাচাই করে ইসলাম ধর্মে কি ফিরে আসতে পারতাম? ইসলাম যে আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম সেটা কি মেনে নিয়ে ইসলামের আলোতে নিজের জীবনকে রঙিন করতে পারতাম? জন্ম সূত্রে মুসলমান হওয়া যে কত বড় সৌভাগ্যের সেটা এই আলোর ধর্মে যারা ফিরে এসেছে তারাই শুধু উপলব্ধি করতে পেরেছে।

ফিরে আসার গল্প বইটি পড়তে গিয়ে সব চেয়ে যে বিষয়টা নিজেকে নাড়া দিচ্ছিল সেটা হলো যে ফিলিস্তিন আফগান মানুষদের সন্ত্রাসী ভেবে তাদের নিউজ কাভার করতে গিয়ে তাদের সাদাসিধে ব্যবহারিক জীবন, তাদের আতিথেয়তা তাদের আন্তরিকতা এসবে মুগ্ধ হয়ে পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মে আগ্রহশীল হন সেই সাংবাদিক।
তাই এটা হলফ করে বলা যায় মানুষের কাছে প্রিয় হবার জন্য বেশি কিছু করার প্রয়োজন পড়েনা। দেখা হলে একটু হাসি। তার সাথে আন্তরিক নম্রতার ব্যবহার। মাঝে মাঝে নিজ খাবার থেকে এক টুকরো ভাগ, দেখা হলে তার মঙ্গল কামনা এমন মামুলি অনেক কিছুই আপনার প্রতি অন্যের মুগ্ধতার জন্য অনেক সময় যথেষ্ট হয়ে পড়ে।

কেউ যদি আলোর পথে ফিরতে চায়, সত্য ও সঠিক পথের সন্ধান চায় তাহলে স্রষ্টা তাকে অবশ্যই সে পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন। কারণ, তখন যদি স্রষ্টা সে সঠিক পথের বা আলোর পথের সন্ধান না দিয়ে থাকেন তাহলে স্রষ্টাকেই এক সময় জিজ্ঞাসা করা হবে, কেন আমাকে শাস্তি পেতে হবে আমি তো চেয়েছি তোমার মনোনীত ধর্মের সঠিক পথে আসতে। খুঁজেছি পথে পথে আলোর দিশা, কই আমি তো সে পথের দিশা পাইনি তাহলে কেন আজ আমাকে শাস্তি পেতে হবে?

বইটি পড়ার পরে আমার মত আপনাদেরও মনে এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। আসুন আমরাও নিজেদের কে একটু যাচাই করে নি। যদি এমন হয় অন্য ধর্মের বা অন্য রাষ্ট্রের এইরকম কেউ যদি আমাদের সাথে পরিচয় হয়, তাহলে আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এমন কি কোন গুণ আছে যে গুণের মুগ্ধতা তাকেও আমাদের এত সুন্দর ধর্মের প্রতি আগ্রহশীল করে তুলবে? নাকি আমরা তাদেরকে উল্টো ঠকানোর সুযোগ খুঁজবো। অথবা খারাপ ব্যবহারে উল্টো তার মন বিষিয়ে দিবো।

©️ বই রিভিউ: রাশেদুল হায়দার

বই: দ্যা রিভার্টস: ফিরে আসার গল্প
রুপা্ন্তর: সামছুন রহমান ওমর ও কানিজ শারমিন
গার্ডিয়ান পাবলিকেশন

ফেসবুক লিংক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Recent Post

শুভ জন্মদিন ২০২২

আজ আমার তেত্রিশ মতান্তরে পঁয়ত্রিশতম শুভ জন্মদিন! (বয়সে করোনাকালিন হিসেব বাদ দেয়া হয়েছে) ছবিটি আনুমানিক ২০ বছর আগের হারিকেন জমানার। ছত্রিশ ফিল্মের কোডাক ক্যামেরার। মেঘে মেঘে বয়স তো আর কম হলো না। সেই ১৫ টাকা সের চাল সময়কার ছেলে আমি। ৪০ টাকা নিয়ে বাজারে যেতাম। এর মধ্যে মাছ-তরকারি, মুদি সদায় সহ দুই টাকা বাঁচিয়ে .....

বই: প্রোডাক্টিভ মুসলিম

বইটি পড়ে কিছু ব্যাপারে আচার্য হয়েছি। বইটি হাতে নিয়ে পড়ার আগে মনে করেছিলাম, এর ভিতরে লেখা থাকবে শুধু কাজ আর কাজ। কিসের ঘুম, কিসের বিশ্রাম আর কিসের অবসর। হয়তো বলা থাকবে, এই দুনিয়াতে কি শুধু ঘুমাতে আসছেন। শুধু কাজ করেন আর অন্য কিছু নয়। পরবর্তীতে ঘুমের উপর চ্যাপ্টার পড়ে আরও বেশি আচার্য হয়েছি যে, .....

বই: ইন দ্য হ্যান্ড অব তা-লে-বা-ন

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। মঙ্গলবার। নিউইয়র্ক-বাসীর সকালটা শুরু হয় অন্যান্য দিনের মত! সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা নিউইয়র্কের লোকজন খুব সকালে উঠে যার যার অফিস শুরু করেছে। প্রতিদিনকার সকালের মত হয়তো কেউ কেউ চা-কপি দিয়ে মাত্র অফিস ডেক্সে ওইদিনের মত নিজেকে সেট করে নিচ্ছে। পৃথিবীকে নাড়া দিতে যাচ্ছে এমন কোন ঘটনা ঘটতে চলেছে তখনও এই .....

বই: ফজর আর করব না কাজা!

আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম! মাত্র ফজরের আজান হয়েছে। সামনের বাসার আঙ্কেলের বড় গেটের তালা খোলার খটখট আওয়াজ। তারপর আমার মোবাইলের এক নাম্বার এলার্ম ভেজে উঠলো। একরাশ বিরক্তিসহ এলার্ম বন্ধ করলাম। এই আলতো ঘুমের এমন ঝনঝন তালা খোলার শব্দ আর এলার্মের এমন ভিট-ঘুটে আওয়াজ সত্যিই বিরক্তিকর ছিলো। তারপর কোন রকম উঠে দায়সারা ভাবে নামাজ ঘরে .....

বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ রিভিউ: এ আমি কি দেখলাম?

অফিস থেকে মনে হয় একটু তাড়াহুড়া করেই বের হয়েছি। আজকে বাংলাদেশের চির প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলা। কয়দিন আগেও এই অস্ট্রেলিয়াকে মিরপুরের মাঠে আমরা কচুকাটা করেছি। সেই হিসেব মতে আজ একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই উপভোগ করবো। টানটান উত্তেজনা থাকবে। বাংলাদেশ হাড় কাঁপানো ব্যাটিং করবে। মাঠ কাঁপানো ফিল্ডিং করবে। টানটান করে বাউন্ডারি হাঁকাবে। দর্শক সাড়ি থেকে বাংলাদেশ! .....

নাফাখুম জলপ্রপাত – নেটওয়ার্কের বাইরে একদিন

আজকে যাবো। কালকে যাবো। এই বর্ষায় যাবো। এমন করতে করতে এক ট্যুরের প্ল্যান চলে প্রায় দুই বছর ধরে। এর মধ্যে করোনা। লকডাউন। শাটডাউন। মাস্ক। স্যানিটাইজার ইত্যাদি ইত্যাদি পৃথিবীতে নতুন করে আগমন করেছে। অন্যদিকে নাই হয়ে গেছে অনেক পরিচিত মানুষ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-অনাত্মীয়। প্রতি বছর একটা জংলী ট্যুর দেয়ার ইচ্ছে থাকে। বড়সড় একটু গ্রুপ করে কোন .....

All Post