বই: ইন দ্য হ্যান্ড অব তা-লে-বা-ন
১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। মঙ্গলবার। নিউইয়র্ক-বাসীর সকালটা শুরু হয় অন্যান্য দিনের মত! সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা নিউইয়র্কের লোকজন খুব সকালে উঠে যার যার অফিস শুরু করেছে। প্রতিদিনকার সকালের মত হয়তো কেউ কেউ চা-কপি দিয়ে মাত্র অফিস ডেক্সে ওইদিনের মত নিজেকে সেট করে নিচ্ছে।
পৃথিবীকে নাড়া দিতে যাচ্ছে এমন কোন ঘটনা ঘটতে চলেছে তখনও এই হিসেব কারও কাছে নেই।
নিউ ইয়র্ক সময় ৮টা ৪৮ মিনিটে বোস্টন থেকে ছেড়ে আসা একটি বিমান আঘাত আনে টুইন টাওয়ারের উত্তর টাওয়ারে। পরপর আরেকটি আঘাত পরবর্তী দক্ষিণ টাওয়ারে। পুরো পৃথিবী হতভম্ব, স্তম্ভিত এবং হতভাগ! আমেরিকাকে আঘাত ব্যাপারটা চারটি খানি নয়! এত বড় সাহস কার?
সানডে এক্সপ্রেস (লন্ডন) এর সাংবাদিক এই বইয়ের লেখিকা ইভন রিডলি সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পান। তিনি নিউ ইয়র্ক যাওয়ার বিমান টিকেট হাতে পান। নিউ ইয়র্কের বিমানে উঠার আগ মুহূর্তে বার্তা কক্ষ থেকে সংবাদ আসে নিউ ইয়র্ক নয় তাকে পাকিস্তানের ইসলামাবাদের বিমানে চড়ে বসতে!
কারণ, খোদ আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ এই হামলার জন্য কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়া তা-লে-বা-নদের দায়ী করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন এবং তা-লে-বা-নদের বিরুদ্ধে আমেরিকা ক্রুসেড ঘোষণা করেছেন। এর ছেয়ে উত্তেজনার খবরই তখন আর কি হতে পারে? তাই লেখিকা নিউইয়র্ক না গিয়ে সংবাদে সংগ্রহের জন্য পাকিস্তান যাওয়াটাই যৌক্তিক।
এখন মূল আলোচনায় ফিরে আসি।
ইন দ্য হ্যান্ড অব তা-লে-বা-ন বই ইভন রিডলির একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ। বইয়ে গল্পে গল্পে গাঁথা হয়েছে লেখিকার বন্দি জীবনের কাহিনী। একাধারে এই বই একটি কাহিনী নির্ভর উপন্যাস বা একটি লোমহর্ষক ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে ধরা যায়। পড়তে একটু থ্রিল থ্রিল ভাবও আছে! বইয়ের কাহিনীতে ডুব দিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন খাইবার পাস হয়ে পাহাড়ের গিরি পথ ধরে আফগানিস্তানের গ্রামগুলোতে!
সবার প্রথমে যে কথা বলে রাখা উচিত, এটা কোন ইসলামিক বই না! লেখিকা ইভন রিডলি এই বই লেখারও প্রায় দুই বছর পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। এই বইয়ের ২৪০ পৃষ্ঠার ১৮০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ইভন রিডলি শুধু এক চোখা পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তা-লে-বা-নদের মধ্যযুগীয় বর্বর, জঙ্গি, সন্ত্রাসী এবং আদিম মানুষ যারা আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে অনেক দুরে এমন ধারণা মনে করে গেছেন। যদিও এখানে লেখিকার কোন দোষ নেই, সব পশ্চিমা সর্বসাধারণের মতই তিনি মুসলিম মানুষদের তথা আফগানদের একই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেছেন। এইটাই স্বাভাবিক।
আবার এই কথাও লেখিকা সুবিচার করে বলেছেন, যে দেশে সকাল সন্ধ্যায় বোমা পরার আশঙ্কা মানুষ মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকে; যে দেশে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা মৌলিক কাজের একটি সে দেশের মানুষকে আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে দুরে ভাবনাটাই ভুল!
এই বই পড়ার আগে সবাই দুই ধরনের আশা নিয়ে পড়া শুরু করে। এক. ইভন রিডলি বইয়ের বর্ণনাতে তালেবানের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করবেন এবং আমেরিকা যে তাদের উপর প্রতিদিন বোমা বর্ষণ করছে এইটা ঠিকই করছেন এই কথাটাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। দুই. টুইন টাওয়ার হামলা তা-লে-বা-নরাই করেছেন এটার একটা শক্ত প্রমাণপত্র লেখিকা হাজির করবেন।
তাই আপনাদের হতাশ করেই এই কথা বলতে চাই, এই বই মূলত ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার হামলা আসলেই কি তা-লে-বা-নরা করেছে কিনা এটার কোন প্রমাণ পত্র নয়। খোদ আমেরিকা পর্যন্ত ১১ সেপ্টেম্বর হামলায় আফগানিস্তান থেকে হয়েছে এই বিষয়ে কঠিন কোন প্রমাণ দানে ব্যর্থ। আমেরিকা ধরেই নিয়েছে কেউ যেহেতু হামলা করেনি তাহলে তা-লে-বা-নরাই করেছে! না হয়তো হামলার দিনই তাড়াহুড়ো করে তা-লে-বা-নদের দোষ দিয়ে প্রেসিডেন্ট বুশ এই সিদ্ধান্ত দিতেন না যে, “আমরা এই হামলার জন্য আফগানিস্তানকে উচিত শিক্ষা দিব”।
এই বইটি মূলত ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী কি কি ঘটেছিলো আর কি কি ঘটতে পারে তা নিয়ে শুধু মাত্র লেখিকার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে। লেখিকা কিভাবে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছেন, কিভাবে ধরা পড়েছেন এবং ছাড়া পেতে কি কি প্রসেসে এগিয়েছেন রঙেঢঙে গল্পে তার একটি বিশদ আলোচনা করেছেন।
পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের অনুপ্রবেশের দু:সাহসিক এক ফন্দি আঁকেন এই লেখিকা। খাইবার পাস সীমান্ত দিয়ে বোরখা পরে ছদ্মবেশে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ইভন রিডলি। দুই দিন কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ফেরার পথে তা-লে-বা-নদের হাতে ধরা পড়েন। ইভন রিডলি যেদিন ধরা পড়েন সে দিন যদি তাকে হত্যা করা হত তাও ব্যাপারটা অযৌক্তিক হতো না! এটা ইভন রিডলি নিজের মুখেই শিকার করেছেন। কারণ, মাত্রই যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা দেশে হঠাৎ কোন বিদেশির অবৈধ ভাবে আগমন এবং তার কাছে নিজেকে গুপ্তচর নয় এমন প্রমাণ দেয়ার জন্য কোন কাগজ-পত্র বা পাসপোর্ট ছিলো না। এমন কি ইভন রিডলি যে একজন সাংবাদিক তার কোন আইডি কার্ড পর্যন্ত ছিলো না। ছিলো না আফগানিস্তান প্রবেশের কোন অনুমতি পত্র। তাকে আমেরিকার গুপ্তচর ভেবে হত্যা করে এই ঝামেলা মিটানোই ছিলো তখন তা-লে-বা-নদের জন্য সহজ সমাধান। এবং ইভন রিডলিকে হত্যা করা হবে ইভন রিডিলি নিজেই যেটা ধরে নিয়েছেন। যেহেতু, তাকে হত্যা করা হয়নি তাই ভেবেছে হয়তো তাকে জুলুম নির্যাতন আর ধর্ষণের মাধ্যমে হয়তো শেষ করে দিবে। ধর্ষণের ব্যাপারটা লেখিকা তার লেখাতে অনেক হাইলাইট করেন। উনি ধরে নিয়েছেন, তারমত সোনালী চুলের সুন্দরীকে পেলে কে-বা সুযোগ হাতছাড়া করবে!
রিডলি আটক হওয়ার পর তা-লে-বা-নরা তাকে অনেকবার জেরা করেন। তিনি সাংবাদিক পরিচয় দেন। কিন্তু তা-লে-বা-ন গোয়েন্দারা খবর পান যে, রিডলি গুপ্তচর। এজন্য তাকে ছাড়া হচ্ছিলো না৷ রিডলি ছাড়া পেয়ে এসে জানতে পারেন, খোদ আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাকে তা-লে-বা-নদের কাছে গুপ্তচর সাজাতে চেয়েছিলো। গুপ্তচর ভেবে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিককে তা-লে-বা-নরা যদি হত্যা করে তাহলে এই অজুহাতে হলেও তাদের উপর হামলার একটা বৈধতা পাবে আমেরিকা! আর সারা বিশ্ব জানবে তা-লে-বা-নরা সাংবাদিক হত্যা করেছে!
ইভন রিডলি তা-লে-বা-নদের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ একরোখা আচরণ করতে থাকেন। যার বিপরীতে তিনি পেয়েছেন মুচকি হাসি। সেটা লেখিকাকেও অবাক করেছে। রাতে ইভন রিডিলির রুমের বাহিরে তালা লাগিয়ে রাখা হতো যাতে কারও দ্বারা কোন প্রকার হেনস্থার স্বীকার না হন। তা-লে-বা-নরা তাকে প্রশ্ন করার সময় ইভন রিডিলির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি রেখে কথা বলতো। ইভন রিডলি তখনও এই সব বিষয়কে উপহাসের বিষয় মনে করে হাসতেন।
এই সব ঘটনা প্রবাহগুলো ইভন রিডলির চিন্তার বিপরীতে ঘটছে। যেখানে তাকে বন্দি করে দুখে দুখে বর্বরোচিত ভাবে ধর্ষণ করে করে হত্যা করা হবে সেখানে এইসব আচরণ ইভন রিডলিকে ভাবিয়ে তুলে।
দশদিন বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান ইভন রিডলি। মুক্তির পর বিশ্বের প্রায় ২৮০টি টিভি চ্যানেলের সংবাদের শিরোনাম হন এই লেখিকা। পরতে হয় নানাবিধ পশ্নের সামনে। সবাই খুব আগ্রহের সাথে জানতে চাচ্ছিলেন যে, “তোমাকে কি কি ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে এবং কেমন বা কিভাবে কতবার ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে”।
একজন ব্রিটিশ ট্যাক্সি চালক রিডলিকে চিনতে পেরে প্রশ্ন করে, ‘তা-লে-বা-নরা তোমাকে কতবার ধর্ষণ করেছে?
রিডলি ট্যাক্সি চালকে বলেন, ‘তারা তো এমন কিছু করেইনি উল্টো আমার প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে।
তখন ট্যাক্সি চালক বলেন, এমন সুযোগ পেলে নাকি চালক নিজেই এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করত!
এই কথাতে রিডলি প্রচণ্ড ধাক্কা খান৷ প্রকৃত বর্বর তিনি কাকে মনে করেছেন আর এই বর্বরোচিত কাজ করতে কারা বেশি আগ্রহী তা নিয়ে তিনি দ্বিধায় পড়েন। রিডলির আরেক বন্ধু একই প্রশ্ন করেছিলো। রিডলির সত্যিকারের উত্তর শোনার পর সেই বন্ধু বলেছিলো, ‘তুমি নিজের আত্মসম্মান রক্ষার্থে অনেক সত্য লুকাচ্ছো।’
নিশ্চিত করে বলতে পারি, ইভন রিডলি বিশ্ব গণমাধ্যমকে হতাশ করেছেন। যে রগরগে টগবগে সংবাদ তারা আশা করেছিলেন লেখিকা তার উল্টো খবর দিলেন। এই হতাশাজনক খবরের জন্যই আবার আমেরিকা তাকে বন্দি করে নাই সেটাই তার ভাগ্য। বাংলাদেশ হলে তো তার থেকে আর গোপন খরব আছে এই জন্য রিমান্ড চেয়ে বসত।
টুইন টাওয়ারে হামলার অভিযোগে আফগানিস্তানে হামলাকে অনেকে জায়েজ এবং তাই করা উচিত বলে মনে করেন। অন্য দিকে আফগানিস্তান যোদ্ধারা যখন এটাকে প্রতিরোধ করতে গেলে তাদেরকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা জঙ্গি আঙ্খায়িত করেন বিশ্ব মিডিয়া। এখানে সাধারণ জনগণের সাথে মূল খেলাটা খেলে মিডিয়া। মিডিয়ার এক চোখা দৃষ্টির কারণেই কেউ সন্ত্রাসী আর কেউ সংগ্রামী। তা-লে-বা-নরা মূলত দুই ধরণের এক. তা-লে-বা-ন আসলেই যে ধরণের। দুই. বিশ্ব মিডিয়া তা-লে-বা-নদেরকে যেমন দেখায়!
রিডলি মুক্ত হয়ে ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করেন। ২০০৩ সালে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তা-লে-বা-নদের হাতে বন্দি থাকা কালীন এক তা-লে-বা-ন নেতা তাকে একটি পবিত্র কুরআন উপহার দেন এবং ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। রিডলি তখন কথা দিয়েছিলেন আমি যদি মুক্ত হয় তাহলে এই ব্যাপারে ভেবে দেখব। বর্তমানে রিডলি ইসলামি ব্যক্তিত্ব হিসেবে খুবই সুপরিচিত এক নাম। সাথে ইসলাম বিদ্বেষীদের এক গাত্রদাহ বটে। হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। মহান আল্লাহ যাকে যান হেদায়েত দেন আর যাকে চান তার গোমরাহির উপর ছেড়ে দেন।
রিভিউ: রাশেদুল হায়দার
বই: ইন দ্য হ্যান্ড অব তা-লে-বা-ন (In The Hand of Ta-li-ban)
লেখিকা: ইভন রিডলি (Yvonne Ridley)
অনুবাদ: আবরার হামীম
(রিভিউটি লেখার জন্য আমি বিভিন্ন ব্লগ এবং ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন তথ্যের কিছু কিছু জায়গায় হেল্প নিয়েছি)
Leave a Reply