শাকিল নামের ছেলেটি
দরজায় ঠকঠক কড়া নাড়ার শব্দ। চিকনা লিকলিকে লম্বা গড়নের একটা ছেলে। ঘরে ঢুকেই সালাম দিলো। কানে ইয়ার-ফোন, শার্টের বোতাম খোলা, উসকো খুসকো চুল, চাল চলনে দেখতে পুরাই পাঙ্খা!
পরিচিত হয়ে জানতে পারলাম ছেলেটির নাম শাকিল। এই প্রথম ঢাকাতে এসেছে। প্রথম সাক্ষাতেই সে আমাকে বললো, “আংকেল…!!” আংকেল ডাক শুনে আমি একটু অপ্রস্তুত ও কিছুটা হতাশ হলাম।
২০১৫ সালের কথা। আমি আর সাইফুল ভাই তখন ঢাকা ফার্মগেটে একটা জনবহুল মেসে থাকতাম। এক রুমে তিন জন। কয়দিন পরপর আমাদের রুমমেট পরিবর্তন হয়। সে সুবাদে নতুন নতুন ছেলেপুলের সাথে পরিচয় হত। আমাদের এবারের নতুন রুমমেট শাকিল।
প্রথমেই শাকিলকে বুঝিয়ে দিলাম রুমের কিছু নিয়ম-কানুন । রাতে ১২টার মধ্যেই লাইট অফ। সকাল ৮টার আগে নো হাল্লা-চিল্লা, নো মোবাইলে কথা-বার্তা। অলওয়েজ পরিষ্কার পরিছন্ন থাকবা, বিছানা পত্র গুছিয়ে রাখবা। শাকিল তখন এসএসসির ফল প্রার্থী। ঢাকাই এসেছে ইন্টারমেডিয়েট ম্যাথ প্রাইভেট আর সাথে ইংলিশ স্পোকিং কোচিং করে নিজেকে একটু এগিয়ে রাখতে । প্রথম প্রথম তার মনে কত প্রশ্ন আর আজব আজব জিঞ্জাসা! ভাইয়া ওটার কি হইছে? ভাইয়া এটার কি ঠিক আছে? তার কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষার এত প্রশ্ন শুনে আমার আর সাইফুল ভাইয়ের হাসতে হাসতে নাভিশ্বাস অবস্থা।
আস্তে আস্তে আমার সাথে শাকিলের সখ্যতা হলো। আমি যেখানে যায় সে আমার সব সময়ের সঙ্গী। সকালে ফজরের নামাজ, বিকালে হাঁটতে যাওয়া, একসাথে খাওয়া। সে একদিন বলেই ফেললো, ভাইয়া আমি তো আপনার পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট (পিএস)! আমি বললাম, কও কি মিয়া! আমি নিজেই এক জুনিয়র অফিসার তার জন্য আবার অ্যাসিস্টেন্ট! তারপরেও তোমাকে একটা পদ দেওয়া দরকার। আজকে থেকে তোমার পদ হলো, “ সাব এসিসটেন্ট সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার ফর এ জুনিয়র অফিসার।“
টাইটেল টা একটু বড় হয়ে গেলেও তার খুব পছন্দ হয়েছে।
আরে মিয়া তুমি হইলা গিয়া আমার ছোট ভাই। তবে এখন রুমমেট হিসেবে বন্ধুর মত। শাকিল স্বপ্ন দেখতো বড় হওয়ার, বড় ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার, বুয়েটে পড়ার, ঢাবিতে পড়ার। নতুন কিছু জানার তার অদম্য স্পৃহা । খুব গরিব ঘরের ছেলে হলেও তার স্বপ্নের কথা শুনে আমি অবাক হতাম। বাবা সিএনজি চালক। স্বল্প আয়ের মানুষ হয়েও ছেলেকে পাঠিয়েছেন ঢাকা শহরে। বাবার বড় বড় স্বপ্ন। ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। দেশ ও দশের জন্য কিছু করবে ।
কিছুদিন পর শাকিলের এসএসসির রেজাল্ট দিবে। সে খুব চিন্তিত । নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে তার ভালো রেজাল্টের জন্য। সে আমাকে খুব আবেগী হয়ে বলে, ভাইয়া আমি এ-প্লাস পাবো তো? জানেন? এ-প্লাস পেলে আমার আব্বা-আম্মা কত খুশি হবে?
রেজাল্টের দিন সে ফোন দিয়ে কান্না করছে। আমি দুশ্চিন্তাই পড়ে গেলাম। রেজাল্ট খারাপ হয়নাই তো? আমিও প্রায় চুপ। তারপর সে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো, ভাইয়া আমি এ-প্লাস পেয়েছি। এবং শুধু তাই নয় তাদের গ্রামের আশ-পাশের স্কুলগুলোর মধ্যে সে একমাত্র এ-প্লাস অধিকারী।
এইবার শাকিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। সে চান্স পাবে তাকে সে কথা আমি ২০১৫ সালেই বলে দিয়েছি। তখন তাকে নিয়ে আমি একটা গল্পও লিখি। সে অবশ্য এই গল্পের কথা তখনো জানতো না। শাকিল আমার ছোট-খাটো একজন ভক্তও বলা চলে। তাকে বলেছিলাম তুমি ভালো কিছু করলে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। এই গল্পটা শাকিলের জন্য।
অনেক অনেক অভিনন্দন ও দোয়া তোমার জন্য শাকিল। তোমার জন্য আমার গর্ব হয়। তোমাকে অনুপ্রেরণা দিতে পেরেছি বলে আজ আমার অনেক আনন্দ হচ্ছে। জীবনে অনেক অনেক বড় হও। ভালো পথে চলো, ভালো কিছু করো।
তখন আমিও একদিন মানুষকে পরিচয় দিবো, আমি শাকিলের একজন বড় ভাই।
লেখা: রাশেদুল হায়দার
Leave a Reply