ভালোবাসি, ভালোবাসি
ভোরের সকাল। আজকের সকালটা শান্ত, নীরব। রাস্তা ঘাটে তেমন কোন মানুষ নেই। সারারাত গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে রাস্তায় চিড়চিড়ে পানি। হিমহিম পূবালী বাতাসে শীতশীত ভাব। দু’পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রতিদিনের মত আজকেও সূর্য উঠেছে। আজকে সূর্যটা অন্যদিনের ছেয়ে একটু বেশিই লাল। মাঝে মাঝে সূর্যের আলো গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। যেন আলো ছায়ার লুকোচুরি। এসি কর্ম্পাটমেন্টের শীতলতার মাঝে কাঁচের জানালা বেধ করে সূর্যের সোনালী রশ্মি মুখে এসে পড়ছে।
আজকের ট্রেন যাত্রা আমার কাছে একটু অন্য রকম, একটু ভিন্ন। পাশের সিটে বসে থাকা কেউ একজন প্রতিবারের মত কেউ নও। মাত্র দু’দিনের পরিচয়। ঘণ্টার হিসেবে তার থেকেও কম। দু’জনের হাতেই সদ্য বিয়ের টকটকে মেহেদির রঙ। আমার হাতে ঘড়ি। ওর হাতে চুরি, আঙ্গুলে এনগেইজমেন্টের রিং। দু’জনের হাতে হাত। চোখে চোখ। তেমন কোন কথা তখনো শুরু হয়নি। একান্ত কথাগুলো বলার লজ্জা ভাব এখনো কাটেনি। সলজ্জ হাসিতে মুখ দেখা দেখি এতটুকুই যা। মাঝে মাঝে ইশারা ইংগিতে আমাকে কিছু একটা বলে। আবার মাঝে মাঝে চিমটি কাটছে। ওর চিমটিতে অনেক ব্যথা। তারপরেও চিমটি খেতে আমার অনেক ভালো লাগছে।
আমার কাঁধে ওর মাথা। ওর কষ্ট হবে ভেবে আমি তেমন নড়ছিনা। ইয়ার ফোনের দু’প্রান্ত দু’জনের কানে। দু’জনের পছন্দের গানগুলো বাজছে। গানের রোমান্টিক কথাগুলোতে ‘ও’ বারবার চিমটি কাটছে। আমিও মুচকি হেসে বাহিরে তাকিয়ে আছি। ওয়েটার এসে বললো, চা দিবো? এক কাপ চা নিয়ে আমি অর্ধেক খেয়ে বাকি টুকু ওকে দিলাম। কাপের যেদিকে আমি চুমুক দিয়েছিলাম, কাপ ঘুরিয়ে সেও ঠিক ওইদিকে ঠোঁট লাগিয়ে খাচ্ছে। এখনো দু’জনে নিঃশব্দে আছি।
আসতে আসতে ট্রেনের গতি বেড়ে যাচ্ছে। ঝিকঝিক শব্দে চলছে ট্রেন। দুর থেকে হুইসেল দেয়া অন্য ট্রেনের শব্দ। পাহাড়, জঙ্গল আর সবুজ ধান ক্ষেত পারি দিয়ে সামনে যাচ্ছে ট্রেন। সাথে যাচ্ছে আমাদের নিঃশব্দ ভালোবাসা। বড় কোন সেতু পার হতে ঝনঝন শব্দে সে আরও শক্ত করে আমার হাত ধরছে। হাত ধরে সামনে যাওয়ার মাঝেও পিছনে যে কাওকে রেখে যাচ্ছে তার একটা রেশ রয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কান্না জলে যে বিদায় এই হাত ধরার মাঝে তার একটা নির্ভরতা রয়েছে। প্রিয় মা-বাবা ছেড়ে আসার কষ্ট হয়তো আমার কাঁধে মাথা রেখে ভুলতে চাচ্ছে। হয়তো প্রিয় বন্ধু-বান্ধবদের ছেড়ে আসার কষ্টকে মুছে আমার চোখে তাকিয়ে নতুন কোন প্রত্যাশার স্বপ্ন ভুনছে।
দুরে এক পাহাড় দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার পাহাড় ভালো লাগে নাকি নদী? বলল, পাহাড়। আমি বললাম, কেন? ‘ও’ বলল পাহাড়ে উঠলে দু:খগুলো হালকা হয় আর নিজেকে আকাশের কাছাকাছি মনে হয়।
আমাকেও পাল্টা পশ্ন করলো, তোমার? পাহাড় না নদী?
আমি বললাম নদী। কেন? কারণ নদীর ঢেউয়ের মাঝে একটা সূর আছে আর নদীকে দু:খের কথা বলা যাই। আমাকে বললো, “আমাকে তোমার দু:খের কথা বলবে?”
আমি বললাম, তাহলে তো তোমাকে আমার নদী হতে হবে। হবে? তারপর কাঁধ থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। বললো, হব তো। তারপর একটু হাসলো। আমি বললাম তাহলে তুমি হাসতেও জানো? এরপর এমন ভাবে হাসলো, যার জন্য আমি এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম।
এমন সময় ইয়ার ফোনে গান বাজছে।
“অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন।। পেলাম খুঁজে এভূবনে আমার আপনজন।। তুমি বুকে টেনে নাও না প্রিয় আমাকে।। আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমাকে।।“
জিজ্ঞাসা করলাম, ভালোবাসো আমাকে?
বললো, ভালোবাসি।
বললাম সত্যিই?
বললো, সত্যি, সত্যি, সত্যিই ভালোবাসি।
Leave a Reply